শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৮ অপরাহ্ন
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নের খরশন্ডা, কাগজীপাড়া, কেয়াখালী, বাগদাড়ী (কেকেকেবি) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির একাংশের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক, অফিস সহকারী, আয়া ও নৈশ প্রহরীর ৪টি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধকোটি টাকা নিয়োগ বাণিজ্য করেছে পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। পরিচালনা কমিটির বিদ্যাৎসাহী সদস্য ও ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইমরান হোসেন বাবু ও উপজেলার মাগুরখালী ইউনিয়নের তপোবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম নিয়োগ বাণিজ্যের মূল হোতা বলে অভিযোগ করেছে নিয়োগে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা এবং এলাকাবাসী। বিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে পরিচালনা কমিটির দু’গ্রুপের মধ্যে চলছে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ। ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যালয়টির নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে দুর্নীতি, অনিয়মকারী দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে এলাকাবাসী।
বিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রার্থী ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়টি এ এলাকার শিক্ষার্থীদের মাঝে সুনামের সাথে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আসছে। ২০২২ সালের ২৫ মে সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ ৪টি শূণ্য পদে পরিচালনা কমিটি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। পরপরই পরিচালনা কমিটির বিদ্যাৎসাহী সদস্য ও ইউনিয়ন যুব লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইমরান হোসেন বাবু ও কেকেকেবি বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক, মাগুরখালী ইউনিয়নের তপোবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চক্র চাকুরী দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রার্থীদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়। ৪টি পদে আবেদন গ্রহণের পর সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে মো. আকরাম হোসেন, বিপুল বিহারীসহ ৭ জন, অফিস সহকারী পদে মো. রাজু আহমেদ গাজী, মামুন মোড়ল, মিঠুন গাইন, আফতাব মোড়ল ও মেয়াদ শেখ, আয়া পদে শেফালী রানী, মুর্শিদা বেগম, ফাহিমা, কোহিনুর ও জয়শ্রী এবং নৈশ প্রহরী পদে মাহবুব বিশ্বাস, মশিউর রহমান লিটন, সেলিম বিশ্বাস, রেজওয়ান মোড়ল, হযরত মোড়লসহ ৭ জন নিয়োগ পরীক্ষার অংশগ্রহণ করে। ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনার মডেল সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে মো. আকরাম হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়। একইভাবে অফিস সহকারী পদে ১৪ লক্ষ টাকা নিয়ে মো. রাজু আহমেদ গাজীকে, আয়া পদে ১২ লক্ষ টাকা এর মধ্যে নগদ ৭ লক্ষ টাকা ও বাকী ৫ লক্ষ টাকার জামানত বাবদ জমির দলিল রেখে শেফালী রানীকে এবং নৈশ প্রহরী পদে ৮ লক্ষ টাকা নিয়ে মাহবুব বিশ্বাসকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে স্কুলের ও শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র নিয়োগ বাণিজ্য চক্র তাদের আখের গোছাতে যেনতেন প্রকারে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে বলে এলাকাবাসী ও বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে তদন্তপূর্বক যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানিয়েছেন।
নৈশ প্রহরী পদে পরীক্ষা দেয়া বিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী এলাকার মোতালেব মেম্বারের ছেলে সেলিম হোসেন বলেন, ‘‘নৈশ প্রহরী পদে চাকুরীর জন্য আমার খামারের তিনটি গরু বিক্রয় করে তপোবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলামকে ৫ লক্ষ টাকা দেই। নিয়োগ পরীক্ষার দিন পর্যন্ত আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে চাকরীটা আমিই পাবো। কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে বাড়ী আসার পর সিরাজ মাষ্টার আমাকে ডেকে বলে ৫ লক্ষ টাকা দিয়েছো, আরো ৩ লক্ষ টাকা আজ রাতের মধ্যেই দিতে হবে। তা না-হলে এ পদে আমরা মাহবুবকে নিয়োগ দিবো। পরে জানতে পারি মাহবুব ৮ লক্ষ টাকা দেয়ায় আমার পরিবর্তে তাকে চাকরী দেয়া হয়। আমিসহ নৈশ প্রহরী পদে অন্য ৩ প্রার্থীর নিকট থেকেও টাকা নিয়েছিলো সিরাজুল মাষ্টার। চাকরী না হওয়ায় আমিসহ অন্যাদের টাকা ফেরত দেন সিরাজুল মাষ্টার।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি আরাফাত মোর্শেদ জানান, বিদ্যালয়ের ৪টি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ার যে খরচ সেটি যারা চাকরীতে নিয়োগ পাবে তাদের নিকট থেকে নেয়ার জন্য আমি বিদ্যাৎসাহী সদস্য ইমরান হোসেন বাবুকে বলেছিলাম। ঢাকায় বসবাস করার কারণে পরে জানতে পারি প্রার্থীদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের ফান্ডে কোন টাকা জমা দেয়া হয়নি। বরং নিয়োগ প্রক্রিয়ার সব খরচ বিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে নেয়া হয়েছে।
সাহস ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, কেকেকেবি বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রার্থীদের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা করে মোট অর্ধকোটি টাকারও বেশি পরিচালনা কমিটির বিদ্যাৎসাহী সদস্য ও ইউনিয়ন যুব লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইমরান হোসেন বাবু ও কেকেকেবি বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক, মাগুরখালী ইউনিয়নের তপোবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চক্র হাতিয়ে নিয়েছে। এলাকাবাসী ও বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা স্কুলের জন্য মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের প্রত্যাশা থাকলেও এই চক্রের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এমনকি এ চক্রের অন্যতম হোতা কেকেকেবি বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক, মাগুরখালী ইউনিয়নের তপোবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে তাদের পচ্ছন্দের প্রার্থীর জন্য সুপারিশসহ অনৈতিকভাবে প্রশ্নপত্র সরবরাহের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আরো জানান, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উন্নত ও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্য নিয়োগ বাণিজ্যের হোতা মো. ইমরান হোসেন বাবু তার (মোয়াজ্জেম হোসেন) ভগ্নীপতি হলেও অনিয়ম দূর্নীতির ক্ষেত্রে এই চক্রের বিরুদ্ধে এবং নিয়োগকৃত শিক্ষক কর্মচারীদের বিষয়ে তদন্তপূর্বক আইনানূগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান তিনি।
বিদ্যালয়ে আয়া পদে নিয়োগ পাওয়া শেফালী রানী জানান, বিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার জন্য কাউকে কোন টাকা পয়সা দেয়া হয়নি। মেধা তালিকায় প্রথম হওয়ায় কর্তৃপক্ষ চাকুরী দিয়েছে। চাকুরী নেয়ার জন্য এত টাকা কোথায় পাব?
সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রাপ্ত মো. আকরাম হোসেন মুঠোফোনে জানান, নিয়োগের জন্য বিদ্যালয়ের কাউকে কোন টাকা দেয়া হয়নি। আমি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় কর্তৃপক্ষ আমাকে বিধিমোতাবেক নিয়োগ দিয়েছে। এর বেশি আমি কিছু জানি না।
বিদ্যালয়ের বিদ্যাৎসাহী সদস্য ও সাহস ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইমরান হোসেন বাবু বলেন, বিদ্যালয়ের সামান্য বিদ্যাৎসাহী সদস্য হয়ে কিভাবে প্রার্থীদের নিকট থেকে টাকা নিতে পারি। আমি সব সময় বিদ্যালয়ের স্বচ্ছ নিয়োগের কথা বলে এসেছি। বিদ্যালয়ের ৪ টি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন টাকা পয়সার লেনদেন হয়নি। নিয়োগ পরীক্ষায় যারা প্রথম হয়েছে তারাই নিয়োগ পেয়েছে।
আপনার নিকট অবৈধ অস্ত্র রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে মো. ইমরান হোসেন বাবু জানান, বিষয়টি অপপ্রচার ও হাস্যকর। পরিচালনা কমিটির একটি গ্রুপ এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।
তপোবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমি কেকেকেবি বিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে কোনভাবেই জড়িত নই। আমি ওই বিদ্যালয়ের একসময়ের শিক্ষক হলেও এর নিয়োগের বিষয়ে কিছুই জানি না। তবে নিয়োগ পরিক্ষার কেন্দ্রে তার উপস্থিতির বিয়য়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি খুলনা সরকারী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল হোসেনের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
খুলনা সরকারী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘‘কেকেকেবি বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষার দিনে তপোবন স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরীক্ষা কেন্দ্রে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। এসময়ে তিনি তার একজন প্রার্থী আছে জানিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চায় এবং পরীক্ষার হল রুমে আবস্থান করতে চাইলে আমি বাঁধা দিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেই।’’
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. কামরুজ্জামান মুঠোফোনে জানান, কেকেকেবি বিদ্যালয়ের নিয়োগে অর্থ বাণিজ্যের বিষয়ে আমি অবগত নই। আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি অবহিত হয়েছি। এ বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: BD IT SEBA